মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১) উদ্ভাবন
মোঃ মাসুদ রানা
আমরা মাছে ভাতে বাঙালি, বাংলাদেশেরে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির জোগান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও মূল্যবান বৈদশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে মৎস্য সেক্টর সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমরা স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় এবং স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আজ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছি যার স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালির মুক্তির নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়। মাছ চাষের সবচেয়ে বেশি খরচ (মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৬০%) হয় মাছের খাদ্য সরবরাহে, যা জোগান দিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা হিমশিম খেয়ে যায়। মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের খাদ্যের নিরবছিন্ন সরবরাহ থাকা অত্যন্ত জরুরি কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় মৎস্য ও পশু খাদ্যের জোগান কমে যায়। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ বিপদকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মাছের খাদ্যের মূল্য দিন দিন গুণিতক হারে বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় মাছের দাম বাড়ছে না ফলে অনেক মাছচাষি মৎস্য চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে যে স্থান দখল করেছে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে মাছের খাদ্যের খরচ কমানো তথা উৎপাদন খরচ কমানোর বিকল্প কিছু নাই।
মাছ চাষের খাবারের খরচ কমানোর পাশাপাশি খামারিরা যেন নিজের খামারের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবন করা হয় মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১)। মেশিনটি উদ্ভাবনের যাত্রা শুরু ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এবং কাজ সমাপ্ত করতে মোট সময় লাগে প্রায় এক বছর ছয় মাস। মাছচাষিদের খাবারের সরবরাহ ও খরচ কমাতে মেশিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিরাপদ মাছ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ মৎস্য খাদ্য, যা এখন সময়ের দাবি। যেহেতু খামারি মাছের খাদ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেই খাদ্য উৎপাদন করবে সেক্ষেত্রে খাদ্য যেমন নিরাপদ হবে তেমনি ঐ খাদ্য প্রয়োগ করে উৎপাদিত মাছও নিরাপদ হবে।
উদ্ভাবিত মেশিনটির বিশেষত্ব হলো একই মেশিন দিয়ে খামারি মাছের ভাসমান ও ডুবন্ত উভয় প্রকার খাদ্য তৈরি করতে পারবে পাশাপাশি মেশিনটি দিয়ে ০.৫ মিলি থেকে ৫ মিলি আকারের সকল প্রজাতির মাছ ও চিংড়ির খাদ্য তৈরি করা যাবে। শেকৃবি উদ্ভাবিত মেশিনটি দিয়ে মাছের খাদ্যের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ অনান্য যেকোন পাখির খাদ্য তৈরি করা সম্ভব, যা মৎস্য সেক্টরের পাশাপাশি পোলট্রি শিল্পে খুলে দেবে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
মেশিনটিতে অ্যাডভান্সড মিলিং টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে ফলে এটি একটানা ১০-১২ ঘণ্টা খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে, যেখানে ঘণ্টায় ৭০-৮০ কেজি খাবার উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত খাদ্যের নমুনার গবেষণায় দেখা যায় খাবারভেদে আমিষের পরিমাণ ২০-৩৫ শতাংশ এবং ময়েশ্চারের পরিমাণ ১০-১৩ শতাংশ, চর্বির পরিমাণ ৪-৬ শতাংশ, ফাইবারে পরিমাণ ১০-১৪ শতাংশ, অ্যাশের পরিমাণ ১৮-২৩ শতাংশ এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ১-৩ শতাংশ। গবেষক উৎপাদিত মৎস্য খাদ্যের গুণগত মান ও উৎপাদন খরচ হিসেব করে দেখেছেন কার্প মাছের ২২ শতাংশ আমিষযুক্ত গ্রোয়ার বা ১-৩ মিলি আকারের খাবার উৎপাদন খরচ ৩৮-৪০ টাকা/কেজি কিন্তু একই খাবার খামারিকে যেকোন কোম্পানির কাছে থেকে ৫৮-৬০ টাকা/কেজি ক্রয় করতে হয় সাথে পরিবহন খরচ ও সময় তো আছেই। একইভাবে মেশিনটি দিয়ে যেকোন মাছের খাদ্য তৈরিতে প্রায় ৪০% কম খরচ হবে। মাঝে মধ্যে খামারিকে ৭-১০ দিন আগে টাকা পরিশোধ করেও খাবার না পাওয়ার ঘটনা অহরহ আছে, এই সব সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারে শেকৃবি উদ্ভাবিত খাদ্য তৈরির এই মেশিনটি। মেশিনটি সেটআপ করতে ৬-১০ লক্ষ টাকা লাগবে, যা নির্ভর করবে খামারির প্রয়োজনের ওপর, যদি কেউ দিনে ৫০০-৬০০ কেজি খাদ্য উৎপাদন করতে চান তার খরচ হবে ৬ লক্ষ টাকা আর যার দিনে ১ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা দরকার মেশিনটি সেটআপ করতে তার খরচ হবে ১০-১১ লক্ষ টাকা অর্থাৎ মেশিনটির সেটআপ খরচ নির্ভর করছে খামারির উৎপাদন চাহিদার উপর।
শেকৃবি উদ্ভাবিত মাছের খাদ্য তৈরির মেশিনটি মাছ চাষিদের অধিক মুনাফা অর্জনে অগ্রনী ভূমিকা রাখবে যা মৎস্য সেক্টর তথা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
লেখক : উদ্ভাবক (সাউ ফিড মিল-১) এবং সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪৫-৬২৬১৫৩, ই-মেইল : ranadof.bd@gmail.com